clock ,

অপেক্ষা

অপেক্ষা

ঘুমটা হঠাৎ করে ভেঙে গেল তিথির। চোখটা খুলেই বিছানায় পাশে তাকিয়ে দেখে পাশের জায়গাটা খালি..! কখন যে মুন ঘুম থেকে উঠে নীচে নেমে চলে গেছে তিথি টেরই পায়নি। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা ৬টা বেজে গেছে আর অর্ক টে মিসডকল। বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠলো। অফিসে দিনের ছুটি নিয়ে অর্ক আজকে দেখা করতে আসবে বলে ছিল, সন্ধ্যাবেলা দেখা করে সোজা ফ্ল্যাটে চলে যেত। অর্ক এখনই এসে দাঁড়িয়ে নেই তো !

শনিবার আর রবিবার এই দুই দিনই অফিসে ছুটি থাকে তিথির। ছুটির দিনে  বাড়িতে থাকলে  দুপুর বেলাতে মুনকে খাইয়ে  ঘুম পাড়িয়ে নিজে আর জেগে থাকতেই পারে না,তখন থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে ওর টানা ভাতঘুম কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা, মাস পর অর্ক দিল্লি থেকে দেখা করতে আসবে তিথির সঙ্গে। এই ভেবে ভেবে আগের দিন অফিসে ওতো কাজের চাপ থাকার সত্ত্বেও তিথি রাতে ভালো করে  ঘুমাতেও পারে নি। সেই অর্ক সাথে আজকে যদি ওর দেখা না হয়...আর অন্য কোনো কিছু চিন্তা না করে দুরু দুরু বুকে অর্ককে কল ব্যাক করে ফেলে,

- হ্যালো, তুমি কোথায়?

- হ্যাঁ তো, কত বার ফোন করলাম তোমাকে, ধরলে না, কোথায় ছিলে তুমি?

- ইয়ে মানে, একটু চোখ লেগে গিয়েছিল, আগে বলো না... কোথায় তুমি?

- হ্যাঁ, তার জন্য তো ফোন করছিলাম, আজকে আসতে আমার একটু দেরি হবে। ট্রেন লেট আছে ঘন্টা। তুমি আজকে আর মুনকে নিয়ে তো আসতে পারবে না মনে হয়, এত দেরি হয়ে গেলো আমার...

- না মুনকে দেখি মায়ের কাছে রেখে আসবো। তুমি টার মধ্যে আসতে পারবে তো?

- হ্যাঁ পারবো, তুমি হাওড়া স্টেশনে এসে দাঁড়িয়ে থেকো, আমি আসছি।

- ঠিক আছে , সাবধানে এসো ...

- হুম্রাখলাম।

ফোন রেখে তিথি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামে, দেখে মুনের দিম্মা মুনকে দুধ কর্নফ্লেক্স খাইয়ে দিচ্ছে আর মুন হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে বসে আছে আর মাঝে মধ্যে মুখ নাড়ছে। তিথি আড়চোখে দেখে নেয় ঘড়ির কাঁটাটা ৬টা ৩০ মিনিটের দিকে চলে গেছে। তখন তিথি হন্তদন্ত হয়ে ওর মাকে বলে দেয় , “মা, আজকে অর্ক আসবে বেরুতে হবে, মুনকে ঘন্টা দুই মতো তোমার কাছেই রেখে দিও তো, রাতে এসে ওকে আমি খাইয়ে দেব, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না।বলেই মায়ের কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই দৌড়ে ওপরে চলে যায়।

তিথির বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই, সুন্দরভাবে সাজালে ওর বয়স যেন এক ধাক্কাতেই ১০ বছর কমে যায়..! তার উপর অর্ককে এতদিন পর সামনে থেকে দেখতে পাওয়ার উন্মাদনায় তিথির মুখের গোলাপী রঙের আভাটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মুনের ঠান্ডা লেগে যায় একটুতেই, তাই আজকে বেড়ানোর সময় মুন যেন ওর সাথে যাওয়ার বায়না না করে তাই এক প্রকার লুকিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় তিথি। মেট্রোতে করে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যায়, ঘড়িতে তখন ৭টা বেজে গেছে। ফোন করে জানতে পারে অর্কর আসতে এখনোও ৩০ মিনিট মতো দেরি হবে। অগত্যা দোকান থেকে একটা চা কিনে ওয়েটিং রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে তিথির হঠাৎ নজরে পরে নিজের হাতের অনামিকায় সোনার আংটিটার দিকে, আনন্দে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ওর..

তিথির মনে পড়ে, আংটিটা বছর আগে বিয়ের দিন অর্ক ওকে উপহার দিয়েছিল, কিন্তু তখন তিথি কোন চাকরি পায়নি, মনে হলো তখন সময়টাই বুঝি ভালো ছিলো...তখন অর্থাভাব থাকলেও সুখের অভাব ছিল না। নতুন বিয়ের পর একটা ছোট্ট কামরার ফ্লাটে দুজনের সংসার, ফ্লাটের খোলা ঝুল বারান্দাটা সবুজ দিয়ে ছিমছাম ভাবে সাজানো গোছানো, সব কিছু নিজেদের হাতে একটু একটু করে গড়ে তোলা, তখন যদিও কোলকাতার সেই ফ্লাটের .এম.আই দিতে দিতেই অর্কর অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারপরও অর্ক আর তিথি সুন্দর করে সব কিছু সামলে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে কিছু বছর পর অনেক চেষ্টা করে তিথির সরকারি চাকরি পাওয়া, অর্কর উপর অর্থনৈতিক চাপ কমে যাওয়া, দুজনের টাকায় গাড়ি কেনা, নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চমধ্যবিত্তে পরিণত হওয়া আর সর্বোপরি তিথির শরীরের মধ্যে ছোট্ট প্রাণের আগমন এই পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকই ছিল।

বিপত্তি ঘটলো যখন অর্কর দিল্লিতে ট্রান্সফার এর লেটার এলো। সব এলোমেলো হয়ে গেলো, অর্ককে দিল্লিতে চলে যেতে হলো, আর তিথিকে নিজের গর্ভাবস্থার পর থেকে আজকে দিন পর্যন্ত চাকরি সমেত মেয়েকে নিয়ে মায়ের কাছে বাপেরবাড়িতে থেকে যেতে হলো একা। অর্ক সামান্য যা উপার্জন করে দিল্লির মতো জায়গায় ওদের দুজনের চলে গেলেও মুনকে ভালোভাবে মানুষ করা খুবই মুশকিল, তাই তিথি মুনের কথা ভেবে নিজের চাকরিটাও ছেড়ে দিয়ে পাকাপাকিভাবে অর্কর কাছে চলে যেতে পারে নি।

আগে দুজনে একসাথে সংসার করলেও ছুটির দিনে বিকাল হলেই ঠিক দুজনে একসাথে বেরিয়ে পরস্পর সময় কাটাতো..,এটাই তাদের অভ্যাস, এটাই তাদের টান.. এই ভাবে রোজ নতুন করে পরস্পরকে আবিষ্কার করে ওরা মুগ্ধ হতো...

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোনের রিং বেজে ওঠে, দূর থেকে তিথি দেখতে পায় অর্ক কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। সামনে এসে অর্ক আনন্দে দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে তিথির হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে বলে, “আজকে আমরা কোথায় যাব?” (চলবে)

লেখক: বিএ, বিএড, বাংলা সাহিত্য, কুমারটুলি পার্ক, কলকাতা

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য