clock ,

কর্মহারা

কর্মহারা

চোখ খোলা রেখে বুকে হাত দিয়ে টানটান ভাবে শুয়ে আছে শশাঙ্ক। মাথার উপর পাখাটা বনবন করে ঘুরছে। বড্ড টানছে পাখাটা। ইচ্ছে হচ্ছে ওখানে ঝুলে পড়তে। মস্তিষ্ক অন্য ঝামেলায় জর্জরিত। ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা হারিয়েছে। নিজের মনকে সংযত করতে অপারগ হল শশাঙ্ক। বিছানা থেকে উঠেই পড়ল। ফ্যানের সুইচ অফ করে দড়ি খুঁজছে শশাঙ্ক। নিদেনপক্ষে একটা শাড়ি হলেও কাজ হয়ে যাবে। আলমারি খুলল শশাঙ্ক। প্রথমেই হ্যাঙ্গারে ঝোলানো নীল শাড়িতে দৃষ্টি আবদ্ধ হল। নীল রঙ বড্ড প্রিয় শশাঙ্কের..রুমি শাড়ি অঙ্গে ঠেকালে দেবীর স্বরূপ দেখাত। স্ত্রীর রূপে মুগ্ধ হত শশাঙ্ক। এখন এই শাড়ি ফ্যানে ঝুলিয়ে শেষ নিদ্রায় যাবে মন স্থির করল। পাশের ঘরে শুয়ে আছে রুমি আর ওদের পাঁচ মাসের মেয়ে টুলটুলি। রাতে অনেকবার ওঠে টুলটুলি। স্বামীর ঘুমের ব্যঘাত না ঘটানোর জন্য পাঁচ মাস ধরে রাতে পাশের ঘরে শোয় রুমি। খুব একটা প্রয়োজন না পড়লে ডাকে না শশাঙ্ককে..

শেষবারের মত মেয়ে স্ত্রীর মুখাবয়ব দেখার প্রবল ইচ্ছেকে দমন করে ফ্যানে শাড়ির অর্ধাংশ তুলে দিল শশাঙ্ক।

-তোমাদের দেখলে আমি দুর্বল হয়ে পড়ব। হয়ত তখন এই পদক্ষেপটাই নেওয়া হবে না। আমাকে যে মরতেই হবে না হলে তোমরা বাঁচতে পারবে না। টুলটুলি তোর অপদার্থ বাবাকে ক্ষমা করিস।

দুই চোখ উপচে জল এল শশাঙ্কের। শাড়িটা ইতিমধ্যেই ফ্যানে আটকে ফেলেছে। এবার গলায় ফাঁস দিলেই শান্তির আশ্রয়ে পৌঁছাবে। হাতগুলো কাঁপছে শশাঙ্কের..মস্তিষ্ক বাধা দিচ্ছে। কিন্তু মনের কাছে মস্তিষ্কের আন্দোলন ধোপে টিকছে না। মন চিৎকার করে বলছে..

তুই মর। মৃত্যু হলেই তুই বাঁচতে পারবি

-মরতেই হবে। আমাকে মরতেই হবে।

চিৎকার করে কেঁদে উঠল শশাঙ্ক।

-শশাঙ্ক! এই শশাঙ্ক...

রুমির চিৎকারে ঘোর কাটে শশাঙ্কের। টুলটুলির কোনো অনিষ্টের ভয়ে চমকে ওঠে।

-কী গো সাড়া দিচ্ছ না কেন? কী করছ তুমি?

রুমির পিছুডাক উপেক্ষা করতে পারে না। শাড়ি ফেলে টুল থেকে নেমে দরজা খোলে।

-কী হয়েছে টুলটুলির?

স্বামীর বিধ্বস্ত মুখাবয়ব, সেই সাথে ফ্যানে ঝোলা প্রিয় নীল শাড়িটা দেখে দুয়ে দুয়ে চার করেই ফেলে রুমি।

-তুমি সুসাইড করতে যাচ্ছিলে?

বিছানায় বসে বাচ্চাদের মতন কেঁদে ওঠে শশাঙ্ক। স্বামীর পাশে বসে রাগত দৃষ্টিতে তাকাল রুমি।

-তুমি কী করছিলে? কেনই বা করছিলে?

-এছাড়া কি আমার কোনো পথ খোলা আছে? আমি মারা গেলে তোমরা জীবনবিমার টাকা গুলো পাবে। ডবল পাবে...

-...এই ব্যপার...

-ফ্ল্যাটের এম আই, পরের মাসে টুলটুলির অন্নপ্রাশন কী করে হবে। আমি যে নিঃস্ব হয়ে গেছি। তাই এটা পদক্ষেপই ছিল বাঁচার একমাত্র উপায়।

-বুঝলাম...কিন্তু এই টাকায় কী আমাদের সারা জীবন চলে যাবে? তাছাড়া বাবা হারা হয়ে টুলটুলি বাঁচবে কী করে? বাবা সম্বন্ধে কী ধারণা হবে ওর? ওর বাবা জীবন যুদ্ধে হেরে আত্মহত্যা করেছে।

-জীবন যুদ্ধে হারিনি। আমার সাথে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। অনেক কষ্ট করে পড়ে সরকারি চাকরিটা পেয়েছিলাম। হঠাৎ করে সেই চাকরিটা চলে গেলে যে কী হয়...সেটা যে কত লজ্জার.. বুঝবে না রুমি। তুমি বুঝবে না...

দুই হাতে মুখ ঢাকা দিয়ে কাঁদতে থাকে শশাঙ্ক।

শশাঙ্ককে নিজের বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে রুমি। ফ্যানে তখন নীল শাড়িটা ঝুলছে। সেখানেই দৃষ্টি আটকে গেল ওর।

-শশাঙ্ক কে বলল আমি বুঝব না?

-লক ডাউনে যখন আমার হঠাৎ করে কাজটা চলে গেল তখন আমারো একই উপলব্ধি হয়েছিল। শুধু আমার কেন, আমার মতন লাখ লাখ মানুষ কর্মহারা হয়েছিল। তাদের মধ্যে পরিবারের কর্তাও ছিল। কীভাবে তারা সংসার চালিয়েছিল ভাবতে পারো। লকডাউন ব্যপারটা তোমার কাছে ছুটি কাটানো হলেও আমার কাছে ছিল পঁচিশ হাজার চাকরি হারানোর কষ্ট। তোমার বা তোমাদের মতন শিক্ষকদের চাকরি গেল ষড়যন্ত্রে...আর লকডাউনে চাকরি গিয়েছিল ভয়ংকর পরিস্থিতির চাপে...প্রাইভেট হোক বা সরকারি উভয় ক্ষেত্রেই চাকরি হারানো কষ্টকর গো...

রুমির কথার পরিপ্রেক্ষিতে মৌন থাকে শশাঙ্ক।

-চাকরি হারানোর পর আত্মহত্যাটা এক মাত্র সলিউশন হলে কত পরিবার উজাড় হয়ে বল তো? চাকরি গেছে, জীবন নয়...জীবনের চেয়ে বড় কিছু হয় কী? চিন্তা করোনো কিছু উপায় নিশ্চয় বেরুবে। শুধু তুমি নও, আরো হাজার হাজার মানুষ আছে। আমাদের সেভিংস তো কিছু আছে। পরের মাস থেকে আমি আবার কাজে জয়েন্ট কর। এইচ.আরকে মেইল করছি..

ফ্যালফ্যাল করে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে শশাঙ্ক।

-চিন্তা কোরো না। আমি সব সামলে নেব। শুধু তুমি পাশে থাকলেই হবে। টুলটুলিকে খাওয়াচ্ছিলাম। তখন থেকে ফ্যানের আওয়াজ পাচ্ছিলাম না। তোমাকে নিয়ে চিন্তা তো ছিলই...ভাগ্যিস সঠিক সময়ে এসেছিলাম।

পুনরায় আতঙ্কে নীল হল রুমি। চোখ থেকে বড় বড় ফোঁটায় অশ্রু নির্গত হল। ঠিক তখুনি পাশের ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে এল।

-মেয়েটা কাঁদছে...

ছুটে পাশের ঘরে গেল রুমি।

মাথা নিচু করে বসে রইল শশাঙ্ক।

-না সোনা কাঁদে না..এই তো মা...

পায়ে পায়ে মেয়ের কাছে এল শশাঙ্ক।

-তুমি ঠিকই বলেছ রুমি। বেঁচে থাকাটা আসল...আবার পরীক্ষায় বসে যদি পাস না করতে পারি তাহলে প্রাইভেট জব নেব। নাহলে বাবার ব্যবসাটা তো আছেই..

রুমির কাছ থেকে টুলটুলিকে কোলে নিল শশাঙ্ক।

-বাবা এখন তোর মুখেভাত করতে পারবে না ঠিকই, কিন্তু বাবা কথা দিচ্ছে তোর পাঁচ বছরের জন্মদিন খুব ঘটা করে করবে।

মাথা নিচু করে চুল দিয়ে মেয়ের পায়ে সুড়সুড়ি দিল শশাঙ্ক। খিলখিল করে হেসে উঠল টুলটুলি...

লেখক: গৃহিনী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য