বাংলাদেশ মানে কি শুধু রাজধানী ঢাকা কিংবা বড় শহরগুলো? এর বাইরেও আমাদের দেশে আছে আমাদের গ্রাম নগর বন্দর পাহাড় সমতল। আছে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস। এ বিশ্বাস আর অর্জনগুলো ধরে রাখাই সরকারের কাজ। সরকার বা প্রশাসন মূলত প্রহরী। তাদের হাতে দায়ভার সঁপে মানুষ নিশ্চিত থাকে। তারা জানে, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য আর ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখবে এরা। কিন্তু তা বলে কি পরিবর্তন ঘটবে না? অবশ্যই ঘটবে। আমরা পূর্ব পাকিস্তান দেখা মানুষ। আমাদের শৈশব-কৈশোরে দেখা নববর্ষ ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হলো মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বদেশে। এখন বাংলা নববর্ষ বাঙালির জীবনে কতটা প্রভাব বিস্তার করে আছে, তা বলার দরকার পড়ে না।
কালক্রমে আমাদের দেশে বাংলা নববর্ষ হয়ে উঠল আনন্দ আর ঐক্যের যোগসূত্র। খেয়াল করবেন, ঈদ পূজা বা অন্যান্য সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবগুলোও বেশ ব্যাপক আকারে যথাযথভাবে উদযাপিত হয়। তখন আমরা বলি বা বলতে শুনি, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। যার অর্থ ওই উৎসবগুলোকে সর্বজনীন করার ডাক দিতে হয়। কিন্তু বাংলা নববর্ষে এমন কিছু বলতে হয় না। বলার দরকার পড়ে না। কারণ এটি নিজ থেকেই সর্বজনস্বীকৃত এক সামাজিক ও জাতীয় উৎসব। কালক্রমে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল মঙ্গল শোভাযাত্রা। কেউ চাপিয়ে দেয়নি বা করতে বলেনি। সময়ের নিয়মে নানা কারণে অনিবার্য হয়ে উঠল এ মঙ্গল শোভাযাত্রা।
ইউনেস্কো তার ওয়েবসাইটে মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এ শোভাযাত্রা বের হয়। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের হতাশার দিনগুলোয় তরুণরা এটা শুরু করেছিল। শিক্ষার্থীরা অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বাঙালির নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণীর প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা করে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আরও যে কয়েকটি কারণ ইউনেস্কো উল্লেখ করেছে তা হচ্ছে, এই শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়।
এবার তার নাম পাল্টে গেছে। নাম হয়েছে আনন্দ শোভাযাত্রা। নামে কী যায় আসে! যায় আসে কি না সে তর্ক থাক। তবে কেন এ পরিবর্তন তা বোঝা দরকার। সামাজিক মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা চরম পর্যায়ে। সামাজিক মিডিয়া সবসময় সবকিছু ঠিকভাবে তুলে ধরে না। কারণ অসম্পাদিত বা যখন যা খুশি লেখা বা মুছে দেওয়ার নাম মিডিয়া হতে পারে না। তবু এ সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব অনেক। এর দিকে তাকালে এটা নিশ্চিত যে মানুষ এই নাম পরিবর্তনে বিচলিত। মঙ্গল শব্দটি ঠিক কী কারণে অপছন্দ তা বোঝা যাচ্ছে না। যদি এর পেছনে কোনো সংকীর্ণ কারণ থাকে, তা কিন্তু গ্রহণযোগ্য নয়। মঙ্গল নামে সৌরজগতে একটি গ্রহ আছে। আছে একটি বারের নাম। সপ্তাহে ওই বারটি ঘুরে ঘুরে আসবেই। তখন কী হবে? কী হবে আমাদের পর্যটন নগরী শ্রীমঙ্গলের নামের বেলায়? এসব প্রশ্ন উঠছে এখন। ওই যে বললাম, পরিবর্তন দরকার পরিবর্তন প্রায়ই সুফল বয়ে আনে। কিন্তু তার ব্যাখ্যা আর যৌক্তিকতা জানা বা বোঝা জরুরি।
সত্য এই, যতদিন আমাদের দেশ আমাদের সংস্কৃতি আমাদের জীবন ততদিন, বাংলা-বাঙালির নববর্ষ থাকবে। এর বিনাশ নেই। তবু মাঝে মাঝে আমাদের সমাজে নতুন যত উপদ্রব হাজির হয়। দীর্ঘ সময় ধরে নববর্ষের ভাতা নেওয়া মানুষজনের এক বিরাট অংশ মজে আছে অসাম্প্রদায়িকতা আর উদারতা বিরোধিতায়। এরা কী চায়—তা আমরা বুঝি। কিন্তু রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা নেই বলেই তাদের উগ্র চেহারা দেখি। দেখতে বাধ্য হয় জাতি। একটি আনন্দমুখর সর্বজনীন দিনকে বিতর্কিত না করলেই নয়?
এমনিতেই আমাদের আনন্দ সীমিত হয়ে আসছে। বাঙালির অপরাজনীতি গ্রাস করে নিয়েছে অনেককিছু। এ নববর্ষ আমাদের আনন্দ দেশ-বিদেশে বাংলাদেশিদের উৎসব। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত এ উৎসবকে তার পথে চলতে দিতে হবে। এতেই সবার আনন্দ আর দেশের শান্তি।
বাংলাদেশের বাইরে যে বিশাল বাঙালি ভুবন তাতেই এর শক্তি নিহিত। একুশে যেমন প্রবাসীদের হাত ধরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করেছে; তেমনি নববর্ষও পারবে আপন ঔজ্জ্বল্যে রুখে দাঁড়াতে। প্রয়োজন বাঙালি হওয়ার সাধনা। আশ্চর্যের বিষয় এই, আমরা যারা বাইরের দেশে থাকি আমরাও গণতান্ত্রিক সমাজে থেকে অগণতান্ত্রিক আচরণে অভ্যস্ত। আজকাল কথায় কথায় মারো কাটো ভাঙো—এর প্রকোপ। এমনটা হলে তো রুদ্ধ হয়ে যাবে এগোনোর পথ। উপায় একটাই, বাইরের নিরাপদ সমাজ ও দেশে একতাবদ্ধ হয়ে লড়াই করা। আজকাল লড়াই ময়দানে হয় না। হয় মগজে। হয় সংস্কৃতি আর শিল্পে। সে জায়গায় আমরা যারা বাঙালি বাংলা ভালোবাসি তারা এগিয়ে। আমাদের সঙ্গে আছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, হাছন রাজাসহ অসংখ্য সব গুণী মানুষ। যাদের নামই তাদের পরিচয়। এ জাতি তাই হারবে না। হারতে পারে না।
নববর্ষ আমাদের সূতিকাগার। জেগে ওঠার এক মন্ত্রণা। যতবার আমরা কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছি বা হই ততবার সংস্কৃতি আমাদের পথ দেখায়। নববর্ষ মানেই গান বাজনা আনন্দ আর শোভাযাত্রা। যাদের তা অপছন্দ বা ভালো লাগে না তারা আলোবিরোধী। তারা অন্ধকারের প্রাণী। পেঁচার জন্য তো সূর্য মুখ লুকিয়ে থাকবে না। মনে রাখা দরকার মূল ভূখণ্ড অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ আজ নানা সংকটে। তাদের শান্তিও আনন্দ হাতছাড়া হওয়ার পথে। তারুণ্য বিদ্রোহ করতে জানে, প্রাণ দিয়ে একনায়ক বা অচলায়তন হটাতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতা বা অতীতের কোনো বিকল্প হয় না। যারা প্রবীণ, যারা অভিজ্ঞ, তারা চুপ থাকা মানে দেশ ও জাতিকে অতলে ঠেলে দেওয়া।
খেয়াল করে দেখবেন খুব কম জাতির ভাগ্যেই এমন রমরমা উৎসব থাকে। থাকে এমন প্রীতিময় নববর্ষ। বাদ্যবাজনা, সংগীত, নৃত্য, কবিতায় নববর্ষ মানেই আমাদের জীবনবোধের বহিঃপ্রকাশ, যা দেখে বিদেশিরাও মুগ্ধ হয়। আমি অনেক বিদেশিকে চিনি, জানি, যারা এমন নববর্ষ ও আনন্দময়তার কারণে বাঙালিকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। এই অর্জন সংহত করার দিকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে দিল নিউইয়র্কের বাঙালি জনগোষ্ঠী। তাদের স্যালুট। সময় থেমে থাকে না। তার কাজ এগিয়ে চলা। প্রজন্মের পর প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে হলে সবাই মিলে কাজ করাই হচ্ছে শক্তি।
জয় হোক নববর্ষের জয় হোক বাঙালির।
লেখক: সিডনিপ্রবাসী ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?