যে মানুষটি একদিন দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন, তার চোখে ছিল একটি স্বপ্ন—পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো, দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা। আজ সেই স্বপ্ন বহন করে দেড় কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। তাদের রক্ত ঘামে আসে বছরে প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার—বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রধান উৎস।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (BMET)-এর তথ্য বলছে, এই অর্থে গড়ে উঠেছে গ্রামের অবকাঠামো, শিক্ষিত হয়েছে সন্তান, বদলে গেছে পরিবারের ভাগ্য। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে—দেশে ফিরে আসার পরে কি এই রেমিট্যান্সযোদ্ধারা তাদের প্রাপ্য সম্মান ও নিরাপত্তা পান?
অস্বীকৃত কিন্তু অবিচ্ছেদ্য অবদান
প্রবাসীরা দিনের পর দিন মরুভূমির উত্তাপে, ঠান্ডায় জমে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যে অর্থ পাঠান, তা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তাদের জীবনের বিসর্জনে তৈরি হয় গ্রামে নতুন ঘর, সন্তানরা পায় উচ্চশিক্ষা, শহরে গড়ে ওঠে ব্যবসা। কিন্তু এই শ্রমিকরা যে অবদানের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, সেটি প্রায়শই রাজনৈতিক কৃতিত্বের মোড়কে হারিয়ে যায়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের জন্য কোনো স্পষ্ট ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা চোখে পড়ে না।
রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও অব্যবস্থাপনা: একটি নৈতিক ব্যর্থতা
বেশিরভাগ
প্রবাসী শ্রমিক ২০-৩০ বছর
কাজ করে দেশে ফেরেন।
কিন্তু দেশে ফিরে পান
না কোনো স্থায়ী সামাজিক
নিরাপত্তা কাঠামো—না পেনশন, না
সামাজিক বীমা, না মানসিক স্বাস্থ্য
সহায়তা। বরং ফিরে পান
অচেনা বাস্তবতা, অবহেলা ও একাকিত্ব।
বিশ্বের বহু দেশে যেমন
ফিলিপিন্সে ‘Overseas
Workers Welfare Administration (OWWA)’-এর
মতো প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা রয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো সেখানে নীরব দর্শক। আমাদের
দেশেও একটি কার্যকরী সামাজিক
সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা কি
অসম্ভব?
ভবিষ্যতের দিকে অন্ধ রাষ্ট্রযন্ত্র
বাংলাদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। তারা দেশে ফিরে পড়েন প্রান্তিকতার ফাঁদে। ফলে, এই আত্মত্যাগী মানুষগুলো সমাজে হয়ে ওঠেন ‘অপ্রয়োজনীয়’ এক শ্রেণি, যাদের সম্মান নেই, পরিচর্যা নেই, গর্ব নেই। এই রাষ্ট্রীয় অন্ধত্ব একদিন আমাদের সমগ্র অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
নীতিগত পরিবর্তন: সময়ের দাবি
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এই যোদ্ধাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা। এজন্য নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
১. জাতীয় রেমিট্যান্স পেনশন স্কিম: প্রবাসীদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক
পেনশন স্কিম চালু করতে হবে।
২. পুনর্বাসন ও রি-স্কিলিং
প্রোগ্রাম: দেশে ফেরা প্রবাসীদের
জন্য কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত
করতে হবে।
৩. উদ্যোক্তা তহবিল ও বিনিয়োগ সহায়তা:
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য সহজশর্তে ঋণ
ও তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে।
৪. মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যসেবা
ইউনিট: অভিবাসন-পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় বিশেষায়িত
সেবা গড়ে তুলতে হবে।
৫. জাতীয় স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা প্রথা:
তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করার জন্য একটি
বার্ষিক জাতীয় সম্মাননা চালু করা যেতে
পারে।
নৈতিক অধঃপতন থেকে আত্মমুক্তির সময় এখন
আজকের বাংলাদেশে, যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আত্মসম্মান এবং মর্যাদার জন্য লড়াই করছি, সেখানে দেশের অভ্যন্তরে রাজনীতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি এবং ভণ্ডামি আমাদের সর্বশ্রেণির জনগণের ভবিষ্যৎকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী আজ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ আমরা জানি—দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের অদূরদর্শী প্রতিরোধ আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতির পথকে অস্বাভাবিকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের অবস্থা এখন এমন, যে কেউ আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয় বরং বরাবরই আমাদের দুর্নীতির কারণে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে।
আমরা জানি, উন্নত রাষ্ট্রসমূহ থেকে যে ধরনের বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা আসার কথা, তা নির্ভরশীল দেশীয় নীতির ওপর। আর সেই নীতি যখন দুর্নীতিগ্রস্ত, অসৎ ও অদূরদর্শী, তখন আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে আমাদের দেশের মূল্যায়ন আশানুরূপ থাকে না। আমাদের দরকার একটি নৈতিক, যোগ্য এবং দক্ষ নেতৃত্ব, যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী, জনগণের কল্যাণে কাজ করবে। আমরা এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাই, যারা দুর্নীতির পথ পরিহার করবে এবং জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতি পালন করবে।
এখানে স্পষ্টভাবে বলতে চাই—রাজনীতির নামে দুর্নীতি আর বাংলার মাটিতে চলবে না। মালিকদের অধিকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের অধিকার পর্যন্ত সুষ্ঠু এবং ন্যায়সংগত পরিবেশ তৈরি করা উচিত, যেখানে কোনো ধরনের অপব্যবহার ও অশান্তি সহ্য করা হবে না। রাজনৈতিক তৎপরতা যদি জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করতে থাকে, তবে সেগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। বাংলাদেশের মাটিতে এমন পরিস্থিতি পুনরাবৃত্তি হতে আমরা আর কোনোভাবেই অনুমতি দেব না।
রাষ্ট্রযন্ত্র যদি আজও অবহেলার কূপে বন্দি থাকে, তবে ইতিহাস একদিন এই ব্যর্থ রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই।
রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের জন্য ন্যায়, রাষ্ট্রের জন্য আত্মশুদ্ধির ঘন্টাধ্বনি
পহেলা মে—এটি কেবল শ্রমিক দিবস নয়, এটি রাষ্ট্রের আত্মা জাগানোর দিন। আজকের এই দিনে আমরা যদি সেই পরিশ্রমী হাতগুলোর দিকে না তাকাই, যারা প্রিয়জন ছেড়ে মরুপ্রান্তরে ঘাম ঝরিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে, তাহলে আমাদের বিবেক মৃত।
অন্তত পহেলা মে—শ্রমিকদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়ার যেমন দিন, তেমনি রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা পূর্ণ করার দিন। তাদের অবদানকে জাতির উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে না রাখলে উন্নয়ন শুধু ঢাকের বাদ্য হবে—গভীরতা থাকবে না। রাষ্ট্রের উচিত, নিজের দায়িত্ববোধ থেকে এই প্রবাসী জনগণের পাশে দাঁড়ানো।
আমরা চাই না করুণা, চাই ন্যায্যতা। আমরা চাই না সংবর্ধনার ফুল, চাই সামাজিক নিরাপত্তার শিকড়। রাষ্ট্র যদি আজও এই শ্রেণিকে অবহেলা করে, তবে একদিন ইতিহাস তাকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই।
এই লেখা একটি আবেগ নয়—এটি সময়ের গলায় চেপে বসা এক নৈতিক হুঁশিয়ারি। আজ না হলে কাল, কাল না হলে ইতিহাস—এই রাষ্ট্রকে উত্তর দিতেই হবে। তাই, পহেলা মে শুধুই স্লোগান বা ফুল দেওয়ার দিন নয়— এটি হোক আত্মসমালোচনার, আত্মোন্নয়নের ও দায়িত্বশীলতার প্রতীক।
রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের
অবসরকালীন জীবন যেন হয়
নিরাপদ, সম্মানজনক ও মানবিক— এটাই
হওয়া উচিত আমাদের রাষ্ট্রনীতির
পরবর্তী ধাপ। যে রাষ্ট্র
তার ঘামের শ্রদ্ধা দিতে জানে না,
সে উন্নয়নের মুখোশ পরে নিজের মাটিকেই
অস্বীকার করে।
আমরা একটি রাষ্ট্র চাই—ক্ষমতার নয়, মর্যাদার নামেই
যার পরিচয় হবে।
লেখক: গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?