১৭ এপ্রিল ১৯৭১, ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে মেহেরপুরের এক ঘন আমবাগানে। চারপাশে পাখির ডাক, পাতার ফাঁকে ঝিলমিল সূর্যকিরণ—প্রকৃতি যেন নিজেই সাক্ষী হতে চেয়েছিল এক অনন্য ইতিহাসের।
সেদিনই প্রথমবারের মতো শপথ নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকার। আর এই নাটকীয় ও গোপনীয় আয়োজনের পেছনে ছিল অসংখ্য সাহসী মানুষের নিরব প্রচেষ্টা, যার একজন তৎকালীন মেহেরপুরের সাবডিভিশনাল অফিসার তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, “সব সময় একটা ভয় ছিল যদি পাকিস্তান আর্মি আক্রমণ করে বসে! কিন্তু একটা সাহসও ছিল—আমরা জানতাম, এটি ইতিহাসের মুহূর্ত।”
শেখ
মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানের কারাগারে।
তাঁর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঐদিন ঘোষণা দেন
অন্তর্বর্তী সরকারের: প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী
এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম
কামরুজ্জামান। পাশাপাশি, কর্নেল এম এ জি
ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়।
মঞ্চে ছিল সাতটি চেয়ার—একটি ছিল খালি, শেখ মুজিবের জন্য। তা যেন তাঁর প্রতীকী উপস্থিতিকে মনে করিয়ে দেয়।
স্থান নির্বাচন, নিরাপত্তা, মঞ্চ নির্মাণ, আসবাব সংগ্রহ—সবই হয়েছিল যুদ্ধাবস্থার মধ্যেও নিখুঁত পরিকল্পনায়। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং তাঁর বন্ধু মাহবুব নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন গার্ড অব অনারের বিকল্প ব্যবস্থাও, কারণ ইপিআরের ইউনিট সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি।
“আমরা ভেবেছিলাম অনুষ্ঠানটা একরকম গোপনে করবো, দ্রুত শেষ করবো। কিন্তু যখন অতিথিরা আসতে শুরু করলেন—একশোর বেশি সাংবাদিক, বিদেশিরাও ছিলেন—তখন টের পেলাম, এটি শুধু একটা ঘোষণা নয়, এটি বাংলাদেশের নতুন সূর্যোদয়,” বলেন তিনি।
গণপরিষদের স্পিকার ইউসুফ আলী পাঠ করেন ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’। এরপর শপথ বাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের। তাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, “আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থিত সাংবাদিকদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই… আপনারা কষ্ট করে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি দেখে যেতে এসেছেন।”
সেদিন উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলামও। তিনি বলেন, “সরকার গঠন হওয়ায় আমি এটাকে একটা পজিটিভ দিক হিসাবে দেখেছি। তখনই বুঝেছিলাম, পাকিস্তানিরা কখনোই এখানে জয়লাভ করতে পারবে না। স্বাধীনতা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।”
প্রথম শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে আমবাগান আবার নীরব। “সবকিছু শেষ হওয়ার পর মনে হচ্ছিল, যেন রূপকথার রাজকন্যাকে সোনার কাঠি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো,” বলেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
আজও সেই আমবাগান সাক্ষ্য দেয় এক সাহসিকতার, এক অঙ্গীকারের, এক অদম্য স্বাধীনতার গল্পের—যেখানে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল গাছের ছায়ায়, মাটির গন্ধে, এবং মানুষের আত্মত্যাগে।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?