১৯৭৪-এর ২১ মে, সকাল সাড়ে ১০টা। ঢাকা থেকে কলকাতা বিশেষ বিমান। পুরো একটি প্লেনে একজনই যাত্রী। ২২ বছর বয়েসী যাত্রীটির নাম দাউদ হায়দার। পেশায় খন্ডকালীন সাংবাদিক, নেশায় কবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের নির্দেশনায় সেই অভিযাত্রা। কারণ, কবির জন্যে দেশে তখন চরম নিরাপত্তাহীনতা। মৌলবাদী বা ধর্মানুরাগী সমাজ উত্তাল। মহানবী (সা:) কে ‘তুখোড় বদমাশ’ বলেছে কবিতায়। আর যায় কই, মিছিল বেরুলো সারাদেশে। ফাঁসির দাবিতে বজ্রকঠিন শ্লোগান। কেউ কেউ মাথার দাম হাঁকলো ১০ হাজার টাকা।
‘সংবাদ’ সম্পাদক আহমদুল কবির বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ধরলেন। কারণ তরুণ দাউদ হায়দার সংবাদ-এর সহকর্মী। বিতর্কিত কবিতাটিও ছাপা হয়েছে ‘সংবাদ সাহিত্যে।’ সিনিয়র কবি-সম্পাদকেরাও বঙ্গবন্ধু-সকাশে রাখলেন অনুরোধ। দুই পর্বে কথা রাখলেন দেশপ্রধান মহা-মুজিব।
১৩ টি বছর পশ্চিমবঙ্গেই কাটালেন নির্বাসিত কবি। খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশংকর রায়ের অভিভাবকত্বে। ১৯৮৬ তে ঢাকা সফর করেন বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস। জার্মান লেখক, তখনও নোবেল পুরষ্কার পাননি। ঢাকাদর্শনে কবি-লেখক বেলাল চৌধুরী হলেন প্রধান গাইড। তরুণ লেখক হিসেবে আমরাও ছিলাম পেছন পেছন। ‘ক্যামেরার কবি’ নাসির আলী মামুন ছবি তুলছিলেন। ‘ঢাকা গড়ার নদী’ বুড়ীগঙ্গা তখন অপরূপ। ইঞ্জিন নৌকায় ভ্রমণানন্দের মাঝেই এলো বিষয়টি। “আমাদের একজন বিপ্লবী তরুণ কবি বিপদাপন্ন। ধর্মীয় প্রতিবাদীদের কারণে ভারতে নির্বাসিত। তুমিতো কলকাতা যাচ্ছো, পারলে সাহায্য করো।” কবি বেলাল চৌধুরী চমৎকারভাবে কথাটি পাড়লেন। ভ্রমণসঙ্গীনি মিসেস গুন্টার বললেন, কী তার পরিচয়?
আমার পরিচয়
ভুলে যাও ভিটেমাটিদেশ, তুমি উদ্বাস্তু, আশ্রিত।
তোমার স্বদেশ বলে কিছু নেই, তুমি পরগাছা, তুমি মৃত।
তোমার সামাজিকতা, তোমার পারিপার্শ্বিক
তোমার চেহারা তোমার চালচলন
উদ্বাস্তুর ; আমাদের ঘৃণা-করুণায় তোমার জীবন।
এদেশ তোমার নয়, এই ভিটেমাটি জমিন তোমার নয়
তুমি আশ্রিত, উদ্বাস্তু; এই তোমার মানব পরিচয়।
(আমার পরিচয়: দাউদ হায়দার)
কলকাতা গিয়ে কথা রাখলেন কথক গুন্টার গ্রাস। প্রায় দু‘মাসের পশ্চিমবঙ্গ সফরের মধ্যেই ঘটলো ঘটনা। জার্মান প্রশাসন এবং জাতিসঙ্ঘে কথা কললেন। সমস্যা দেখা দেয় পাসপোর্ট না থাকা নিয়ে। ১৯৭৬ সালেই দাউদ হায়দারের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ। কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনে নবায়নের আবেদন করলেন। কিন্তু ১০ বছরেও তা ফেরৎ পেলেন না। অবশেষে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদের কাছে চিঠি। দাউদ লিখলেন আপনি কবি আমিও কবি। দেশে ফেরার অনুমতি হোক না হোক। নবায়নকৃত পাসপোর্টটি ফিরে পেতে চাই।
না বরফ গলেনি, কোন কাজ হলো না। কারণ ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ঘোষণা করেছে সরকার। এখন 'ইসলাম বিরোধী কবি'কে রাষ্ট্রীয় সাহারা দেয়া অসম্ভব। মৌলবাদীরা এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে নামবে।
সরকারের না-বোধক সিদ্ধান্তটি অবশ্য সুফল আনলো। গুন্টার গ্রাসে'র মধ্যস্থতায় জাতিসঙ্ঘ ইস্যু করলো ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট।’ যা দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশ ঘুরেছেন কবি। এক সাক্ষাৎকারে বলেন গোপনে পাবনাও গিয়েছি। মা অসুস্থ ছিলেন, ঝটিকা সফরে দেখেও এসেছি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আতিথ্য হলো মাতৃকোল। কিন্তু জার্মানে ঢোকার পর আর ফেরা হয়নি।
সেবার পৈতৃক জমিজমার দলিলে স্বাক্ষরও করেছেন। মায়ের প্রয়াণের পর নিয়তি আর সুযোগ দেয়নি। জার্মানীতে ‘ডয়েচে ভ্যালে’ মিডিয়ায় ব্যস্ত পেশাজীবন। আজীবন অকৃতদার বা অবিবাহিত থেকে গেছেন। তবে অনেকের সাজানো সংসারে শতবার অতিথি হয়েছেন। অ্যামেরিকায় কবি কাজী জহরুল, ইউসুফ রেজা‘র আতিথ্য নেন। ২০১৪ সালে 'মুক্তধারা নিউইয়র্ক বইমেলা' উপভোগ করেন।
পাবনার ‘সাহিত্যপ্রধান’ হায়দার পরিবারে দোহারপাড়ায় জন্ম। দাউদ হায়দারকে বলা হতো ‘জন্মগত বিপ্লবী।’ কারণ ঐতিহাসিক মাতৃভাষা আন্দোলন দিবসেই পৃথিবীতে আগমন। রক্ত স্মৃতিগাঁথা ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি। ৮ ফাগুনের আগুন ঝরা সৃষ্টিকাব্যের কৃষ্টিকবি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ: ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ।’
"জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত
হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই, পালাই পালাই সুদূরে
চৌদিকে রৌদ্রের ঝলক
বাসের দোতলায় ফুটপাতে রুটির দোকানে
দ্রুতগামী নতুন মডেলের
চকচকে বনেটে রাত্রির জমকালো আলো,
ভাংগাচোরা চেহারার হদিস
ক্লান্ত নিঃশব্দে আমি হেঁটে যাই
পিছনে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা যুবক।
অষ্টাদশ বর্ষীয়ার নিপুণ ভঙ্গী
দম্পতির অলৌকিক হাসি, প্রগাঢ় চুম্বন
আমি দেখে যাই, হেঁটে যাই,
কোথাও সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়া চাল--
অর্থাৎ আমার নিবাস।
(জন্মই আমার আজন্ম পাপ / দাউদ হায়দার)
একজীবনে লিখে গেছেন প্রায় ৩০ গ্রন্থ। কবিতা, কথাসাহিত্য, অনুবাদ, সাক্ষাৎকার, ভ্রমণগদ্যও। তবে সবচে আলোচিত: জন্মই আমার আজন্ম পাপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই বইটি আলোচিত।
সাহিত্যপ্রধান ‘হায়দার পরিবারে’ নাম-খ্যাত ৬ সহোদর। পাচঁজনের সঙ্গেই আমার বহুমাত্রিক স্মৃতি। জিয়া হায়দার, অধ্যাপক, লেখক, নাট্যকার। শেষ দেখা ২০১৪ সালে নিউইয়র্কে, প্রয়াত। রশীদ হায়দার, কথাসাহিত্যিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। বাংলা একাডেমি ও নজরুল ইনস্টিটিউট-এর উচ্চ পদধারী। শেষ দেখা নিউইয়র্কে, ঢাকায় অকাল প্রয়াত। মাকিদ হায়দার, বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত কবি। বিসিক-এর উধর্তন কর্মকর্তা, শেষ দেখা ঢাকায়, প্রয়াত। জাহিদ হায়দার, সত্তর দশকের ঋদ্ধ কবি। দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন বা আছেন। শেষ দেখা ঢাকাস্থ সাদাকালো-নিউজব্যাংক হলে। আরিফ হায়দার, নাট্যকলার অধ্যাপক, শিল্পী। শেষ দেখা ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে। অবশেষে কবি দাউদ হায়দারও পৃথিবীর পাট চুকিয়েছেন। ২৬ এপ্রিল‘২৫-এ জার্মানির বার্লিনে প্রবাস-প্রয়াণ। অর্থাৎ ‘রোজ কিয়ামত’ ছাড়া সাক্ষাতের আর সুযোগ নেই। বার্লিনে অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়ি থেকে নামতে আঘাতপ্রাপ্ত। ৭৩ বছরের ভারী দেহ, কর্কট রোগে আক্রান্ত। আধাজাগরণ পরিস্থিতিতে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে স্থানান্তর। ঢাকা থেকে নির্বাসনে যান ১৯৭৪-এর মে মাসে। ৫১ তম বর্ষপূর্তিতে ২০২৫-এর এপ্রিলে সেই নির্বাসনেরও চিরবসান।
বাংলাদেশের খ্যাতিমান অনেকেই কাছে-দূরে নির্বাসনে। রাজনীতিক শেখ হাসিনা গং, তারেক রহমান, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা। বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন প্রমুখ। সেই নির্বাসন তালিকার প্রথম নামটি দাউদ হায়দার। বিশ্বখ্যাত লেখকদের মধ্যে অনেকেই নির্বাসিত হয়েছেন। সালমান রশদী অ্যারিস্টটল, বায়রন, পাবলো নেরুদা, টিএস এলিয়ট। কিংবা ভলতেয়ার, ভিক্টর হুগো, অস্কার ওয়াইল্ড- কারারুদ্ধও ছিলেন।
কবি দাউদ হায়দারকেও প্রথমে কারাবরণ করতে হয়। বিপ্লবী কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৩-এ, দৈনিক সংবাদে। শিরোনাম ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোস্নায় কালো বন্যায়।’ এই কবিতায় তিন ধর্মীয় কর্ণধারকেই আক্রমণ করেন। যথা মহানবী (সা:), যীশু খ্রীস্ট, গৌতম বুদ্ধ। কবির ভাষ্য > পৃথিবীতে এতো হানাহানি, বিগ্রহ কেনো। ধর্মের প্রবক্তা-পুরুষেরা প্রশান্তি দিতে ব্যর্থ হলেন কেনো? তবুণ কবি গালি-গালাজে ধর্ম-প্রবক্তাদের আক্রমণ করেন।
‘অদ্ভুত আলখেল্লা পরিহিত মিথ্যুক বুদ্ধ বোধি-বৃক্ষতলে,
যিশু ভন্ড শয়তান, মোহাম্মদ আরেক বদমাশ
চোখে মুখে রাজনীতির ছাপ...।
(কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায় ॥ দাউদ হায়দার)
কবিতাটির কারণে কবির বিরুদ্ধেই আমজনতার উল্টো-আক্রমণ। ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই দাবিতে প্রকম্পিত মিছিল। ফলে ১৯৭৩-এ ‘নিরাপত্তা কাস্টডি‘র নামে কবির কারাবরণ।
১৯৭৪-এর ২০ মে কারাগারমুক্ত হলে আবার গণ-উত্তেজনা। সরকার-প্রধানের নির্দেশে বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা। কবি দাউদ হায়দারের জীবনে ২১ সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ। জন্মতিথি ১৯৫২-এর ২১ র্ফেরুয়ারি। ঢাকা থেকে কলকাতা গমন ২১ মে'৭৪। আবার ভারত থেকে বার্লিন-জার্মান যাত্রা ২১ জুলাই, ১৯৮৭।
অবশেষে প্রত্যাবর্তনের সুখ আর কপালে জুটলো না কবির। 'সামান্য এক' কবিতার জন্যে পুরোটা জীবন নিষিদ্ধ। বসন্তে জন্ম নিযেও ৫১টি বসন্তই স্বদেশের পত্র-পল্লবহীন। মা, পরিবার, এলাকাবাসী ডাকতো ‘খোকন’ নামে। কতোজনেই আদুরে কন্ঠে ভালোবাসার সুরে ডাকতো--
আয়রে খোকন ঘরে আয়,
দুধ মাখা ভাত কাকে খায়..।
সকল ডাক উপেক্ষা করে সাড়া দিলেন মহাডাকে--
জন্মমাটি, ঘাসের গালিচা খোঁজে শ্বাস,
নির্বাসন যেনো এক নিবর্তনের সন্ত্রাস।
কালেভদ্রে ঘাড়ে চাপে সৃস্টিকর্মে ভূত-প্রেত,
মহাপ্রভু তুমি কি পারো না কুল্লে-হেদায়েত।
পাপের পশম খুলে দেহে দিও পোশাক পবিত্রতার,
ভুলের বাগানে দিও ক্ষমাফুল প্রভু-অবতার।
(শেষ নোঙরের পদাবলি / সাসু, অক্ষরবৃত্ত)
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?